কেওক্রাডং থেকে বগা লেক ৯.৪ কি.মি. ট্রেকিং করে ফিরলাম।
মাথার উপরে সূর্য থাকতে থাকতেই আমরা চলে আসতে পেরেছি।
চিংড়ি ঝর্ণায় একটু বেশি সময় বিশ্রাম নিলেও আমাদের বেশি সময় লাগেনি। ৯.০৫-এ রৌণা দিয়ে দুপুরের মধ্যেই এসে পড়েছি।
উঠেছি লারাম এর বাড়িতে।
মনে হচ্ছে কিছুদিন আগেই ঘরটা তৈরি করেছেন। নিচে ফাকা। কাঠের সিড়ি ভেয়ে উপরে উঠতে হয়। উপরে দুইটা রুম। প্রতি রুমে আট জন করে থাকার ব্যবস্থা আছে। বাহিরে তিন দিক দিয়ে খোলা বারান্দা।
কাপড় চেইঞ্জ করে কাঠের মেঝে খোলা বারান্দায় বসে ডাব খাচ্ছি। বাতাস বইছে। শরীরের ঘাম শুকিয়ে এখন হালকা ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছে। ঘাম শুকালেই গোসল করতে যাবো।
ক্লান্ত লাগছে। তাই উঠতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু গোসল করতে হবে। আর এখন গোসল করে শরীরে জমে থাকা ধূলা-বালি আর ক্লান্তি দূর করতে যাবো রহস্যময়ী বগা লেক-এ।
সবাই বগা লেক এ গোসল করার জন্য নামলাম। নামার সময় পানির নিচে থাকা পাথরে পা পরতেই স্লিপ করে পরে যাই। সামনেই আরেকটি বড় পাথর ছিলো। ভাগ্য ভালো তার উপর পরিনি। তাহলে দাত একটাও থাকতো না।
ছোট থাকা অবস্থায় অনেক সময় ধরে গোসল করতে পারতাম। ডুব দিয়ে অনেক দূর পর্যন্ত যেতেও পারতাম। কিন্তু দীর্ঘ সময় ধরে পানিতে ডুব দিয়ে গোসল করার অভ্যাস না থাকার কারনে এখন আর ডুব দিয়ে গোসল করতে পারিনা। কানের মধ্যে আঙ্গুল ঢুকিয়ে ডুব দিতে পারি। কিন্তু বেশিক্ষণ থাকতে পারিনা। সেই ভাবেই পানিতে ডুব দিচ্ছি।
মনে পড়ছে আগে গ্রামের বাড়িতে থাকা অবস্থায় কত ডোবাডূবি করতাম। চোখ হলুদ হয়ে যেতো। তখন শুনেছিলাম গোসলের পর সূর্যের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলে চোখের হলুদ ভাব কেটে যায়। বাড়িতে গেলে মা বকা দিবে সেই ভয়ে আমিও সূর্যের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। আসলে এতে কতটুকু কাজ হতো তা বুঝিনি।
অনেকক্ষণ ধরে আমরা গোসল করলাম। কিন্তু ভয়ে কেউ সাতার কেটে দূরে যাচ্ছি না। তীরের কাছে থেকেই সবাই গোসল করছি।
বগা লেক সম্পর্কে কিছু মিথ প্রচলিত আছে।
এর মধ্যে ইন্টারেস্টিং মিথ হলো, অনেক আগে বগা লেক এলাকায় একটা বিরাট অজগর সাপ ছিলো। সাপটি মাঝে মধ্যে এলাকার মানুষের কিছু ক্ষতি করতো। ছাগল, গরু, মহিষ ধরে নিয়ে খেয়ে ফেলতো। এই নিয়ে মানুষের মধ্যে বিরক্তিভাব চলে আসে।
একদিন সবাই মিলে সাপটিকে মেরে ফেলে।
তারপর কেটে সবাই ভাগ করে সাপটির বিভিন্ন অংশ নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেন।
সাপটির মাথা নিয়েছেন সর্দার।
সর্দারের বউ রান্না করছেন। হঠাৎ তিনি কথা বলার শব্দ শুনতে পেলেন। কিন্তু তিনি কাউকে দেখতে পেলেন না।
তিনি রান্নায় মন দিলেন। কিন্তু তিনি আবার কথা শুনতে পেলেন। পরে তিনি বুঝতে পারলেন, তিনি যে পাতিলে রান্না করছেন সেখান থেকে কথা বলার শব্দ আসছে।
তিনি শুনতে পেলেন, আমি তো তোমাদের তেমন বড় কোন ক্ষতি করিনি। মাঝে মধ্যে শুধু দুই একটা গরু, মহিষ ধরে নিয়ে খেয়ে ফেলতাম। তার জন্য তোমরা আমাকে মেরে ফেললে। আচ্ছা আমাকে মেরে ফেলেছ ভালো কথা কিন্তু একটু ভালো করে মসলা দিয়ে রান্না করবা এটাতো অন্তত আশা করতে পারি।
রান্নার এক পর্যায়ে পুরু এলাকাটি ধ্বসে পড়ে। এবং সেখানে অনেক গভীর গর্তের সৃষ্টি হয়। সেখান থেকেই এই লেকের উৎপত্তি।
প্রায় একঘন্টা পানিতে থেকে উপরে উঠে আসি।
খাবার দেয়া হয়েছে। খেতে গেলাম।
ভাত, আলু ভর্তা, খাসির মাংস, টমেটো দিয়ে ডাল। এখানেও ভাত আগের মতোই শক্ত। তবে রান্না ভালো লাগলো। ডালটা খুবই চমৎকার। পাহাড় বেয়ে দীর্ঘ ৯.৪ কি. মি. ট্রেকিং করে আসাতে ক্ষুধার পরিমান বেশি ছিলো। তাই পেট ভরে খেয়ে নিলাম।
খাওয়ার পর একটু ঘুম ঘুম লাগছে। শুয়া মাত্রই ঘুমিয়ে পড়েছি। ঘুম ভাঙলে দেখি পাচটা বাজে। শুয়া থেকে উঠতে গিয়ে টের পেলাম সারা শরীরে প্রচন্ড ব্যাথা। অনেক কষ্টে উঠলাম। বিকেলে পাহাড়ের উপর উঠে লেকের ছবি নিতে হবে। রেডি হয়ে হাতে ক্যামেরা নিয়ে বেরিয়ে পরলাম।
বগা লেকের পাশের একটি পাহাড়ে আর্মির ক্যাম্প আছে। সেই পাহাড়ের পাশেই আরেকটা উচু পাহাড় আছে। সেখানে তাদের হেলিপ্যাড আছে। আশেপাশে যতগুলো পাহাড় আছে তার মধ্যে এই পাহাড়টাকেই আমার কাছে উপযুক্ত মনে হলো।
মনে হলো এর উপর উঠতে পারলে লেকের সুন্দর দৃশ্যটা নেয়া যাবে। তাই আমি চিন্তা করেছিলাম সেখান থেকে লেকের ছবি নিবো।
গাইড আনোয়ার বললেন, হেলিপ্যাডে যেতে দেয়না। শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল।
তারপরও আর্মির সদস্যের সাথে কথা বলার জন্য গেলাম। কিন্তু হতাস হয়ে ফিরে আসতে হলো।
হেলিপ্যাড থেকে একটু নিচে দিয়েই একটা রাস্তা নিচের দিকে নেমে গেছে। সেই রাস্তা দিয়ে নিচে নামলেই কমলা বাজার। এই রাস্তা দিয়েই রুমার দিকে যেতে হয়।
এখান থেকেও মোটামোটি লেকটার বেশ কিছু অংশ দেখা যাচ্ছে। আর এখান থেকে সূর্য ডুবার দৃশ্যটাও দেখা যাবে। তাই এই জায়গাটাই ঠিক করলাম।
সূর্যের আলো কমে যাচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যে অস্ত যাবে।
সূর্য ডোবার একটু আগে আগে দেখলাম লেকের উপরে পুরু এলাকাটা নীল হয়ে গেছে। এমনিতেই লেকের পানি নীল। তার উপর আকাশও নীল। দুই নীল মিলে পুরু এলাকাটাই নীল হয়ে গেছে।
লেকের কিছু ছবি নিলাম। কিন্তু হ্যালিপেড থেকে ছবি না নেওয়ার আফসোস রয়েই গেলো। তেমন ভালো লাগলো না। পরে সূর্য ডুবার ছবি নিয়ে নিচে নেমে এলাম।
আস্তে আস্তে শরীরের ব্যাথা মনে হচ্ছে বাড়ছে। রুমে এসে ক্যামেরা রেখে কাপড় চেইঞ্জ করে কিছুক্ষণ রেস্ট নিলাম। চিন্তা করছি সামনে আরো একদিন আছে। কি করে এই একদিন পার করবো। এমন সময় গাইড আনোয়ার মোবাইল আর চার্জার নিয়ে যেতে ডাক দিলেন। জেনারেটর চালু করেছে।
বগা লেকে সন্ধ্যার পর জেনারেটরের মাধ্যমে মোবাইল চার্জ দেওয়া যায় বিশ টাকার বিনিময়ে।
রুমার পর আর কোথাও মোবাইল চার্জ দেওয়ার জায়গা নেই। আমার মোবাইলের চার্জ আজ সকালেই শেষ হয়ে মোবাইল বন্ধ হয়ে গেছে।
অবশ্য মোবাইল অন থাকলেও কোন লাভ হতো না। কারন আমার গ্রামীণ আর বাংলালিংকের নেটওয়ার্ক নেই।
ক্যামেরার ব্যাটারির চার্জও লো দেখাচ্ছে। আরো একদিন এই চার্জ দিয়ে ছবি তোলা যাবে না। তাই মোবাইল এবং ক্যামারর ব্যাটারি চার্জারসহ নিচে নেমে এলাম।
নিচে নেমে দেখি সবাই একদিকে ছুটছেন। সবার হাতে মোবাইলের চার্জার। আমিও তাড়াতাড়ি সেদিকে গেলাম। একটা খাতা নিয়ে একজন বসে আছেন। আমার মোবাইল চার্জের জন্য লাগবে বিশ টাকা আর ক্যামেরার ব্যাটারি চার্জের জন্য লাগবে ত্রিশ টাকা। আমার নাম আর মোবাইল নাম্বার লিখে সেখান থেকে চলে আসি।
কেওক্রাডং ছিলো খুবই শান্ত। মাত্র একটি বাড়ি। আর যেদিন আমরা ছিলাম সেদিন শুধু আমাদের টিমের দশ জনই ছিলাম। তাই পরিবেশটা ছিলো শান্ত।
আর বগা লেক খুবই জমজমাট। এটা একটা স্টেশনের মত। অনেকে শুধু এখানেই আসেন। আবার কেউ কেউ এখানে রাতে এসে থাকেন। পরের দিন সকালে ট্রেকিং করে কেওক্রাডং গিয়ে আবার ফিরে এসে রাতে এখানেই থাকেন। তাই সব সময় এখানে লোকে ভর্তি থাকে।
দুই পাশে সাড়ি সাড়ি দোকান। মধ্যে দিয়ে রাস্তা। দোকানগুলোর পেছনে আলাদা করে থাকার ঘর।
রাস্তার মধ্যে একটু দূরে দূরেই আগুন জ্বালিয়ে মানুষ গোল হয়ে বসে আছে। দিনে গরম থাকলেও রাত বাড়ার সাথে সাথে ঠান্ডাও বাড়তে থাকে।
আমরাও আগুন ধরিয়ে গোল হয়ে বসে আছি। হালকা আগুনের পাশে বসে থাকতে বেশ আরাম লাগছে। একের পর এক গান হচ্ছে। সবাই গলা মিলাচ্ছেন। এ এক অন্য রকম আনন্দ।
গানের ফাকে ফাকে আমাদের এই দুই দিনের ঘোরার ফিলিংস শেয়ার করছেন একজনের পর একজন।
কেউ বলছেন অসাধারন। কেউ বলছেন, খুবই এনজয় করেছেন। না আসলে অনেক মিস হতো। আবার আসবেন। অ্যাডভেঞ্চারার্স।
কিন্তু কেউ বলছেন না কেন অসাধারন লেগেছে তার কাছে। কি ভালো লেগেছে। কি দেখার কারনে তিনি মুগ্ধ হয়ে এখানে আবার আসতে চান।
সবার বলা শেষ হলে আমার পালা আসলো। এবার আমাকে বলতে হবে।
আমি শুধু বললাম, ভালো লেগেছে।
আমার এই ছোট দুইটা শব্দ শুনে তারা হতাশ হলেন। আমার কাছে মনে হয়েছে, শহরের কোলাহল থেকে দূরে যেখানে কাজের কোন চাপ নেই, নেই সকালে এসেই মেইল চেক করা, মেইল রিপ্লে করার চিন্তা। তাই ভালো কিছু না দেখলেও মনে হয় অনেক ভালো লাগছে।
অনেকক্ষণ ধরে গান চলছে। আগুন নিভে যাচ্ছে।
আমাদের খাওয়ার জন্য ডাক পড়লো।
রাতে শুধু ভাত, আলু ভর্তা, ডিম বাজা আর ডাল। অল্প করে খেয়ে নিলাম।
আজ আমাদের বার-বি-কিউ করার প্লান নেই। কিন্তু খাওয়া শেষে যখন বাইরে আসলাম তখন দেখি সবাই বার-বি-কিউ করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। দেখে আমাদেরও লোভ হলো।
গাইড আনোয়ারকে মুরগী আনার জন্য পাঠালাম। কিন্তু সে ব্যার্থ হয়ে ফেরত আসলো।
পরে একজন এসে বললেন, তিনি চেষ্টা করে দেখতে পারেন। তবে টাকা লাগবে পাচশত টাকা একটা মুরগীর জন্য। আমরা রাজি হলাম। গাইড আনোয়ার তার সাথে গেলো।
আমরা আবার আগুন জ্বালিয়ে তার চারপাশে বসে আগুন পোহাচ্ছি। কিছুক্ষণ পর দুজনেই নিরাশ হয়ে ফেরত এলো। অর্থাৎ মুরগী পাওয়া যায়নি। আমাদের আর বার-বি-কিউ করা হলো না।
রাত এগারোটা বেজে গেছে।
পঞ্চাশ টাকা দিয়ে মোবাইল আর ক্যামেরার ব্যাটারি নিয়ে এলাম।
কি মনে করে মোবাইলটা নিয়ে বগা লেকের সিড়ির দিকে গেলাম। মোবাইলে দেখি বাংলালিংকের নেটওয়ার্ক আপ-ডাউন করছে। সাথে সাথে মাকে ফোন দিলাম।
মনে মনে দোয়া করছি যেন মাকে প্রথম ট্রাই–এ পেয়ে যাই।
মাকে পেয়ে গেলাম।
যেহেতু নেটওয়ার্ক আপ-ডাউন করছে তাই যে কোন সময় লাইন কেটে যেতে পারে।
তাই প্রথমেই বললাম, মা আমি ভালো আছি। নেটওয়ার্ক ছিলো না। তাই ফোন দিতে পারিনি। আগামীকাল থেকে আমি এভাইলেবল থাকবো। তখন কথা বলব। এখন রাখি।
নিশ্চিন্ত হলাম।
গাইড আনোয়ার তাড়া দিচ্ছে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ার জন্য। কারন খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে আমাদেরকে রুমা যেতে হবে।
আমরা সবাই রুমে গিয়ে শুয়ে পরলাম।
No Comments