Travel

হাওড়া ব্রিজ এবং হাওড়া স্টেশন স্রোতের সামিল

January 7, 2017
হাওড়া ব্রিজ

মানুষ আর মানুষ। স্রোতের মতো মানুষ সামনের দিকে ছুটে চলেছে। আমরাও জনস্রোতের সাথে সামনের দিকে চলা শুরু করলাম।

ছেলে-মেয়ে, বয়স্ক মানুষ, শিশু, তাদের হাতে-কাধে ব্যাগ নিয়ে তারা ছুটছেন। কারো যেন এক মুহূর্ত থামার সময় নেই। পিছনে তাকানোর সময় নেই। চলছে তো চলছেই।

এসেছি হাওড়া ব্রিজ দেখতে। আমরা ব্রিজের বাম দিক দিয়ে হাঠছি। ব্রিজ পার হলেই হাওড়া স্টেশন। সব মানুষ স্টেশনের দিকে যাচ্ছে।

ডানে তাকিয়ে দেখলাম নদীর উপর আশেপাশের বিল্ডিং থেকে আলো পড়ে জ্বলজ্বল করছে। ইঞ্জিন চালিত নৌকা চলছে। কিছু মানুষ নোংরা পানিতে গোসল করছে।

দুই লেনের ব্রিজ। লেনের পাশ দিয়ে লোহার রেলিং আছে। রেলিং এর পরেই প্রশস্ত ফোটপাত। ছবিতে ব্রিজ দেখতে যতটা ভালো লেগেছিলো ব্রিজের উপর থেকে দেখতে ততটা ভালো লাগছে না।

উপরে তাকিয়ে দেখি আড়াআড়ি স্টিলের পাত দিয়ে ব্রিজটিকে বেধে রেখেছে যেন ব্রিজটা ছিড়ে নদীতে পড়ে না যায়। একটা স্টিলের স্ট্রাকচার ছাড়া আর কিছুই মনে হচ্ছে না।

একটু এগুতেই তরকারির দোকান চোখে পড়লো। ব্রিজের উপর প্লাস্টিকের কাগজ বিছিয়ে ভাগা দিয়ে তরকারি বিক্রি করছেন পুরুষ-মহিলারা। যারা বাড়িতে যাচ্ছেন তারা সেখান থেকে কিনে নিচ্ছেন।

এই দৃশ্য আমাদের কাছে অপরিচিত নয়। কিন্তু অবাক লাগছে এমন একটা ব্যস্ত ব্রিজের উপর যেখান দিয়ে প্রতিদিন লাখ লাখ মানুষ পার হচ্ছে সেখানে তরকারির দোকান।

আমাদের দেশে ফোটপাতে, ওভারব্রিজে দোকান দেখেছি। কিন্তু এমন ব্রিজের উপর দেখিনি।

কয়েক বছর আগে খুলনা গিয়ে খান জাহান আলী সেতু দেখতে গিয়েছিলাম। সেখানেও রাতে গিয়েছিলাম। খান জাহান আলী সেতুতে অনেকেই ঘুরতে যায়। ভালো লাগে। নদীর হাওয়া অসাধারণ। কিন্তু সেখানে আমি কোন দোকান দেখিনি।

আমরা যখন টেক্সি করে যাচ্ছিলাম তখন টেক্সি ড্রাইভার আমাদেরকে সাবধান করে দিয়েছিলেন আমরা যেন ক্যামেরা দিয়ে সেখানে কোন ছবি না তুলি। এবং ব্রিজের উপর যেন দাড়িয়ে না থাকি। পুলিশ সবসময় ঘুরতে থাকে। এগুলো করলে আমাদের ঝামেলা হতে পারে।

কিন্তু যেখানে তরকারির দোকান সেখানে না দাড়িয়ে মানুষ কিনবে কিভাবে? আর এর ফলে মানুষের চলাচলে সমস্যাও হচ্ছে।

ব্রিজ থেকে নেমেই হাতের বাম পাশে হাওড়া রেল স্টেশন। ব্রিজ এবং নদীর সাথে যেন লেগে আছে।

সেখানে গিয়ে দেখি মানুষের আরো ভিড়। তিন দিক থেকে হাওড়া স্টেশনে যাত্রীরা ঢুকছেন। সবার একই অবস্থা। কি যেন মিস হয়ে যাচ্ছে। আশেপাশে যেন তাকানোর একটু সময়ও নেই।

এতো মানুষের ভিড় আর কখনো দেখিনি। অবাক হয়ে মানুষের স্রোত দেখছি।

ঢাকাতে রাস্তায় বের হলেই মানুষ আর মানুষ। হাটা যায় না এমন অবস্থা। কিন্তু আমার কাছে সেই মানুষের ভিড় কিছুই মনে হলো না। ঢাকার থেকেও অনেক অনেক বেশি মানুষ এখানে দেখতে পাচ্ছি।

আমরা চারজন হাওড়া স্টেশন থেকে একটু দূরে দাড়িয়ে দেখছি মানুষের স্রোত। এখান থেকে ব্রিজের দিকে তাকিয়ে দেখলাম ছবিতে যেমন দেখেছি ঠিক তেমনটাই দেখা যাচ্ছে। লাল লাইটের কারনে খুবই ভালো লাগছে। মোবাইল বের করে কয়েকটা ছবি নিয়ে নিলাম। ভালো আসেনি।

যেখানে দাড়িয়ে আছি সেখানে পেয়ারা বিক্রি করছেন। একটা পেয়ারা দশ রুপি করে। চারটা চল্লিশ রুপিই রাখলেন। পাচ রুপি কম রাখতে বলেছিলাম। তখন বিক্রেতা বললেন, দশ রুপি করে চারটার দাম চল্লিশ রুপি। তাহলে কম রাখবো কেন? তার কথায় আমরা হিসেব শিখে গেলাম।

বুঝতে পারলাম বাংলাদেশে আমরা যেমন একসাথে কিছু বেশি কিনলে কিছু টাকা কম দেওয়ার অবদার করি এটা এখানে খাটবে না। চুপ করে গেলাম।

পেয়ারা খাচ্ছি আর মানুষের ব্যস্তভাবে আসা-যাওয়া দেখছি।

এই মানুষগুলো প্রতিদিন শহরতলী থেকে এসে কাজ করে আবার বাড়িতে চলে যায়। এতো বিপুল মানুষদেরকে শহরে থাকতে হচ্ছে না। তারা যে আয় করছে তা দিয়ে গ্রামের বাড়িতে কম খরচে ভালোভাবে চলতে পারছে।

অন্যদিকে শহরে মানুষের চাপ বাড়ছে না। ইনডিয়া যে বড় দেশ এবং বিশাল জনগোষ্টি তাদের চলাচলের জন্য ট্রেনই হলো সবচেয়ে ভালো যোগাযোগ মাধ্যম।

আমাদের কমলাপুর স্টেশন থেকে প্রতিদিন ট্রেন আসা-যাওয়া করছে বিভিন্ন গন্তব্যে। আমাদের কোন যোগাযোগ মাধ্যমই ভালো না। শহরে প্রতিদিন গ্রাম থেকে মানুষ এসে ভিড় করছে। এতো মানুষ সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে নগর কর্তৃপক্ষ।

আগে রিক্সার কারনে রাস্তায় জ্যাম লেগে থাকতো। আর এখন প্রাইভেট কারের কারনে রাস্তায় জ্যাম লেগে থাকে। সিকিউরিটির কারনে এবং ভালো যোগাযোগ ব্যবস্থার কারনে সামর্থ না থাকলেও ব্যাংক লোন নিয়ে অনেকে গাড়ি কিনছেন। তাই প্রতিদিনই বেড়ে যাচ্ছে জ্যাম।

এর থেকে বের হওয়ার উপায় কি?

ইনডিয়ায়র মতো আমাদের এখানেও রেলের উপর গুরুত্ব দিতে পারে সরকার। ঢাকার পাশে চারটি জেলাকে কেন্দ্র করে তৈরি করতে পারে শহর।

এবং তার সাথে ট্রেন যোগাযোগ ব্যবস্থা করতে হবে নিয়মিত। আধা ঘন্টায় যেন সেই চারটি শহরে চলে যাওয়া যায় সেই ব্যবস্থা করতে হবে। কমলাপুর থেকে ট্রেন যাতায়াতের কারনে ঢাকাতে সারাক্ষণ সিগন্যালের কারনে জ্যাম লেগেই থাকে। তাই ট্রেন লাইন মাটির নিচ দিয়ে নয়তো উপর দিয়ে নিতে হবে। এর ফলে ট্রেন যেমন চলবে নিরবিচ্ছিন্নভাবে তেমনি ট্রেন চলাচলের জন্য রাস্তায় সিগন্যালে দাড়িয়ে থাকতে হবে না।

সেই চারটি জেলা থেকে সকালে কর্মজীবী মানুষরা এসে কাজ করে আবার সন্ধ্যায় চলে যাবে। তারা যে টাকা আয় করবে তা দিয়ে তারা তাদের পরিবার নিয়ে সেখানে ভালোভাবে থাকতে পারবে।

আরেকটা ব্যবস্থা করা যায়, সেটা হলো ঢাকাতে কোন একতলা বাস চলবে না। সব দ্বিতল বাস চলবে। এর ফলে রাস্তায় একই জায়গা দখল করে দ্বিগুণ যাত্রী নিয়ে চলে যাবে। মানুষকে লাইনে দাড়িয়ে থাকতে হবে না। ধাক্কা ধাক্কি করতে হবে না। একটা সময়ে যখন বাস সার্ভিস ভালো হবে তখন কেউ আর ব্যাক্তি মালিকানায় গাড়ি কিনতে উৎসাহি হবে না। তখন জ্যাম কমে যাবে।

কলকাতাতে আরেকটা বিষয় লক্ষণীয়, তাহলো কলকাতা শহরে রাস্তায় কোন পার্কিং নেই। টেক্সি যাত্রী নামিয়ে দাড়াতে পারবে না। তাকে সবসময় রানিং এর মধ্যে থাকতে হবে। এর রাস্তায় গাড়ি চলতে সমস্যা হবে না।

আমাদের নগর পিতা ব্যবসায়ী।

প্রশাসনে যদি কোন সফল ব্যবসায়ী থাকেন তাহলে জনগণ তার কাছ থেকে অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি ভালো ব্যবস্থাপনা আশা করতে পারেন। এর কারন হলো, একজন ব্যসায়ী জানেন, ঠিক সময়ে একটা কাজ করতে না পারলে কতো মাসুল দিতে হয়।

যেমন আমাদের মেয়র গার্মেন্ট ব্যবসায়ী। তিনি জানেন, ঠিক সময়ে যদি শিপমেন্ট করতে না পারেন তাহলে তাকে কতো ডলার লস করতে হবে। আর তিনি এটাও জানেন, ব্যবসা করতে গেলে কোথায় কোথায় কি ধরনের সমস্যায় পড়তে হয়। কোন জায়গায় ঝাকুনি দিতে হবে দ্রুত কাজ করার জন্য।

তবে যারা গুলশান যাতায়াত করেন তারা বর্তমান ব্যবস্থাপনায় অসন্তুষ্ট। অনেকের অভিযোগ, মাত্র কয়েকটা বাস। তার উপর ভাড়া বেশি। পর্যাপ্ত সংখ্যক রিক্সা নেই। ঠিকমতো প্রি-ওয়ার্ক না করেই এমন একটা সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।

কয়েক মাস ধরে মানুষ গুলশানে যাতায়াত করতে গিয়ে ভোগান্তিতে পড়ছেন। তার সাথে কয়েক মাস ধরে রাস্তা খুড়াখুড়ি, ফুটপাত সংস্কার সব মিলে অসহনীয় অবস্থা বিরাজ করছে।

রাজ্জাক ভাইয়ের ডাকে আমার চিন্তায় ছেদ পড়লো।

তিনি হাওড়া স্টেশনের ভিতরে যেতে চাচ্ছেন। আরিফ ভাই আর রেদওয়ান এতো ভিড়ের মধ্যে স্টেশনের ভিতরে ঢুকতে চাইলেন না।

আমরা মানুষের স্রোতের সাথে মিশে গেলাম। রাজ্জাক ভাই আমার হাত ধরে হাঠছেন।

বুঝতে পারলাম তিনিও ভয় পাচ্ছেন। আমি মনে মনে ভয় পাচ্ছিলাম, ভেতরে ঢুকে যদি আলাদা হয়ে যাই তাহলে আমি এখান থেকে আর বের হতে পারবো না। ভিতরে যে অবস্থা দেখা যাচ্ছে তা আমাদের কমলাপুর স্টেশনে ঈদের সময়ও আমরা দেখি না।

পাশা পাশি হাটছি। রেলের কর্কশ বাশি বাজছে। রেল আসছে। ছেড়ে যাচ্ছে। মানুষের ছোটাছোটি কমছেই না।

আমরা কিছু ছবি নিলাম।

হাটতে হাটেতে আমরা ১৬টা প্ল্যাটফর্ম দেখলাম। হারিয়ে যাওয়ার ভয়ে আর দেখার সাহস পেলাম না। রাজ্জাক ভাই বললেন, জসীম যা দেখার এটুকুতেই চলবে। আমাদের এর চেয়ে বেশি দেখলে আর বের হতে পারবো না। চলো এবার বের হই।

একটা জায়গায় খুব অল্প কিছু মানুষদের বসে শুয়ে থাকতে দেখতে পেলাম। কিন্তু তারা কেন শুয়ে-বসে আছে তা তাদের সাথে কথা বলে আর জানা গেল না। বেরিয়ে যাওয়ার সময় টিকেট কাউন্টার চোখে পড়লো। লাইনে দাড়িয়ে থেকে টিকিট কিনছেন। বেশ ভিড়। কিন্তু কোন হট্টোগোল নেই।

শেষ হলো আমাদের স্টেশন দেখা। বাইরে বেরিয়ে দেখি হাওড়া ব্রিজের লাইট নিভে গেছে। রাতে একটা সময় পরে নাকি লাইট বন্ধ করে দেওয়া হয়।

এবার আর টেক্সিতে করে যাবোনা। উবার বুকিং দেওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যেই চলে আসলো। কলকাতায় আসার পর আমরা উবারেই বিভিন্ন জায়গায় যাচ্ছি।

উবারে বুকিং দেওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যেই গাড়ি চলে আসে। উবার স্ক্রীনে দেখা যায় বুকড হওয়া গাড়ি কতো দূরে, কোন দিক দিয়ে আসছে, কতো সময় লাগবে, গাড়ির ড্রাইভারের নাম, ছবিসহ মোবাইল নাম্বার দেয়া থাকে। চাইলে ড্রাভারের সাথে কথা বলেও নেয়া যায়। টেক্সি থেকে উবারে ভাড়া প্রায় অর্ধেক।

গাড়িতে উঠার পর টের পেলাম প্রচন্ড ক্ষূধা পেয়েছে। কোথায় খাওয়া যায় তাই নিয়ে কথা হচ্ছে। তখন রাজ্জাক ভাই ট্রাভেলার্স অফ বাংলাদেশ-এ পোস্ট দিলেন। সাথে সাথে কমেন্ট আসা শুরু হলো। একজন কস্তুরীর নাম দিলেন। এটাই পারফেক্ট মনে হলো।

কস্তুরী কোথায়, কিভাবে যেতে হবে, কি কি খাবার পাওয়া যায়, কেমন দাম সব তার স্টেটাস থেকে পেয়ে গেলাম। অবাক লাগলো সাথে সাথে এতো রেসপন্স দেখে।

আমরা এখন ছুটছি কস্তুরীর উদ্দেশ্যে।

You Might Also Like

No Comments

Leave a Reply

error: Content is protected !!