Movie Review

মুনলাইটঃ জীবন হারিয়ে যায়

April 22, 2017
মুনলাইট

চারদিকে যখন লা লা ল্যান্ড মুভির জয়জয়কার ঠিক তখনই আস্তে আস্তে মুনলাইট মুভি কৃটিকদের মাঝে আলো ছড়াতে থাকে নিশব্দে।

নিরবে সবার মনে জায়গা করে নিতে থাকে মুনলাইট। কেউ হয়তো বুঝতেই পারেননি মুনলাইট এভাবে নিরবে একটা ইতিহাস করে ফেলবে।

এ যেন মুনলাইট মুভিতে শিরন এরই প্রতিধ্বনি। মুভিতে প্রায় চুপচাপই পেরিয়ে গেছে ছোটবেলা থেকে প্রাপ্ত বয়স্ক পর্যন্ত শিরনের সময়টা।

তার সহপাটিদের ভিড়ে তার উপস্থিতি চাপা পড়ে থাকতো ঠিক তেমনি লা লা ল্যান্ডের কোলাহলের নিচে চাপা পড়ে গিয়েছিলো মুনলাইটের কথা।

হঠাৎ বিবিসি-র প্রতিবেদনে উঠে আসে মুনলাইটের কথা। সেখানে সবাইকে সতর্ক করে দেওয়া হয় মুনলাইট এবার অস্কারের আপসেট হতে পারে।

এবং শেষ পর্যন্ত তাই হয়েছে। তবে অনেক নাটকিয়তার পরে।

ডিরেক্টর ব্যারি জেনকিন্স এর মুভিটি যখন অস্কারে বেস্ট পিকচার অ্যাওয়ার্ড পায় তখন একসাথে কয়েকটি ইতিহাস গড়ে মুভিটি।

যেমন, মুনলাইট মুভিটিতে যারা অভিনয় করেছেন তারা সবাই কালো।

পার্শ্ব চরিত্রে অভিনয় করে প্রথম মুসলিম হিসেবে মাহেরশেলা আলী পেয়েছেন বেস্ট সাপর্টিং অ্যাক্টর অ্যাওয়ার্ড।

সবচেয়ে কম বাজেটের মুভির দিক দিয়ে দ্বিতীয় যার বাজেট ছিলো মাত্র ১.৫ মিলিয়ন ডলার কিন্তু এখন পর্যন্ত আয় করেছে ৫৫.৮ মিলিয়ন ডলার।

এর আগে ২০০৯ সালে দি হার্ট লকার মুভি ছিলো খুব কম বাজেটের মুভি। সে বছর বড় বাজেটের মুভি অ্যাভাটার নিয়ে অনেকেই হইচই করেছিলেন। এবং রেকর্ড পরিমান নমিনেশনও পেয়েছিলো অ্যাভাটার।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত টেকনিক্যাল ক্যাটেগরি ছাড়া তেমন কোন বলার মতো পুরষ্কার নিজের ঝুড়িতে তুলতে পারেনি অ্যাভাটার।

যাই হোক, এতো অল্প বাজেটের মুভি অস্কারে প্রাইজ পেয়ে যায় শুধু ভালো গল্প এবং চমৎকার নির্মাণশৈলির কারনে।

বাংলাদেশে প্রায়ই শুনা যায় বাজেটের অভাবে ভালো মুভি নির্মাণ করা সম্ভব হয় না। তারা অস্কারে প্রাইজ পাওয়া এমন কম বাজেটের মুভিগুলো দেখে অনুপ্রাণিত হতে পারেন।

এতে করে আমাদের মুভি জগতে আবার সুদিন ফিরে আসতে পারে।

মুনলাইট মুভিতে শিরন এর গল্পটা নেয়া হয়েছে ট্যারিল অ্যালভিন ম্যাকক্রানি-র অপ্রকাশিত সেমি-অটোবায়োগ্রাফিকাল নাটক “ইন মুনলাইট ব্ল্যাক বয়েজ লুক ব্লু” থেকে।

যারা মুভিটা দেখবেন তারা একমত হবেন গল্পটা খুবই সাধারণ। কিন্তু নাড়া দেওয়ার মতো।

বাংলাদেশের যে মুভিগুলো হয় সেগুলো নিয়ে প্রধান একটা অভিযোগ শুনা যায়, ভালো গল্প পাওয়া যায়না।

যারা মুভি বানান তারা খেয়াল রাখতে পারেন প্রতি বছর বিভিন্ন উৎসবকে কেন্দ্র করে পত্রিকাগুলোতে গল্প প্রকাশিত হয়। সেখান থেকে ভালো গল্পগুলো নিয়ে মুভি বানানোর চিন্তা করতে পারেন।

তিনটি প্লটে মুনলাইট মুভিতে শিরনকে দেখানো হয়েছে। শিরনের ছোটবেলা, তার বেড়ে উঠা এবং পরিনত যুবক হিসেবে সময়কে দেখানো হয়েছে।

একদিন শিরনকে তার সহপাটিরা তাড়া করলে একটি ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে তারা চলে যায়। সেখানে দেখা হয় কিউবান মাদক ব্যবসায়ী জোয়ান এর সাথে। তারপর জোয়ানের সাথে তার সময় কাটতে থাকে।

কিভাবে সাতার কাটতে হয়, নিজের জীবন নিজেকেই গড়ে নিতে হবে, অন্য কেউ ঠিক করে দিবে না জীবনের লক্ষ্য এমনি অসাধারণ কিছু কথা জোয়ান শিরনকে শুনায়।

একদিন শিরন জোয়ানের বাড়িতে যায় এবং জোয়ান শিরনের কাছে জানতে পারে সে তার মাকে পছন্দ করে না।

এক পর্যায়ে শিরন জোয়ানের কাছে জানতে চায়, তুমি কি মাদক বিক্রি করো?

জোয়ান উত্তর দেয়, হ্যা।

তুমি কি আমার মার কাছেও মাদক বিক্রি করেছো?

এবারও জোয়ান বলে, হ্যা!

শিরন নিশব্দে উঠে চলে যায়।

লজ্জায়, খুবে জোয়ানের চোখ দিয়ে পানি চলে আসে। চিৎকার করে, গলা ফাটিয়ে যা করা যায়না শিরনের নিশব্দে চলা যাওয়া তার চেয়ে বেশি প্রতিবাদি মনে হয়েছে।

টিনএজার সময়ে দেখানো হয়েছে চুপচাপ শিরন হঠাৎ খেপে গেলে কি ভয়ানক কান্ড হতে পারে। প্রতিশোধ নিতে গিয়ে সহপাটিকে প্রচন্ডভাবে আঘাত করে শিরন এবং তারপর সে জেলে চলে যায়।

তার ছেলে বন্ধু কেভিনের সাথে সেক্স এর দৃশ্য যখন দেখানো হয় তখন ২০০৫ সালের ব্রোকব্যাক মাউন্টেন মুভির কথা মনে পড়ে যাবে।

অস্কারে মোট আটটি নমিনেশন পেয়ে সর্বোচ্চ আসনে ছিলো ব্রোকব্যাক মাউন্টেন মুভিটি। কিন্তু বেস্ট ডিরেক্টর, বেস্ট অ্যাডাপ্টেড স্ক্রীনপ্লে এবং বেস্ট অরিজিনাল স্কোর ক্যাটেগরিতে প্রাইজ পেলেও বেস্ট পিকচার অ্যাওয়ার্ড পায়নি।

ঐ বছরে আমেরিকাতে কালোদের নির্যাতিত হওয়ার উপর মুভি ক্রাশ বেস্ট পিকচার অ্যাওয়ার্ড পেয়েছিলো।

তখন গে নির্ভর মুভিটিই ছিলো না পাওয়ার কারন।

সে সময় সাপ্তাহিক যায়যায়দিনে সুমিত রেহমান এর একটা লেখা প্রকাশিত হয়েছিলো যেখানে তিনি লিখেছিলেন, মুভিটি যদি এখন রিলিজ না দিয়ে আজ থেকে দশ বা পনের বছর পরে রিলিজ দেওয়া হতো তাহলে অনায়াসে অস্কারে বেস্ট পিকচার পেতো।

মুনলাইট মুভি তারই প্রমান। যদিও মুনলাইট মুভিটিতে গে পার্টটা ব্রোকব্যাক মাউন্টেন মুভির মতো ব্যাপকভাবে আসেনি।

আর শেষ পার্টে এসেছে নিজেকে জানা, বুঝা এবং সমন্বয় করে নেয় শিরন।

একদিন ফোন আসে তার টিনএজার বয়সের বন্ধু কেভিনের কাছ থেকে যার সাথে বহু বছর ধরে যোগাযোগ বন্ধ ছিলো। তার ফোন পেয়ে তার সাথে দেখা করতে যায়।

তার বন্ধু কুকের কাজ করে। একটি রেস্টুরেন্ট চালায়। গার্লফ্রেন্ড ছিলো। তাদের একটি সুন্দর ছেলে আসে। কিন্তু তারা এখন আলাদা থাকে।

এই কথাগুলো তার বন্ধু কেভিন হেসে হেসে বলছিলো। কিন্তু শিরন আগের মতই চুপচাপ।

তাকে দেখে মনে হচ্ছিলো কথাগুলো শুনে তার মন খারাপ। হয়তো ভাবছে নিজের জীবনটাও এমন হতে পারতো। বা এর চেয়ে ভালো হতে পারতো।

মনে মনে এগুলো ভেবেই হয়তো কষ্ট পাচ্ছে।

মাদক নিরাময় কেন্দ্র থেকে তার মা তাকে প্রায়ই ফোন দিতো দেখা করার জন্য। তার বন্ধুর সাথে দেখা করার আগে সে তার মার সাথে দেখা করতে যায়।

শিরনের ছোটবেলা অনাদর, অযত্নে কেটেছে। মাদক কেনার জন্য জোর করে তার মা তার কাছ থেকে টাকা নিতে চাইতো।

যেখানে মা তাকে দেখে রাখবে, তার অর্থনৈতিক অভাব পূরণ করবে সেখানে মা উল্টো তার কাছ থেকে টাকা নিয়ে নিতো।

এখন ছেলে যখন বড় হয়ে গেছে তখন মা তার কাছে ক্ষমা চাচ্ছে যা সে সময় করার দরকার ছিলো তা না করতে পারার জন্য। এবং তিনি বলেন, আমি যদি তখন তোমার যত্ন নিতাম তাহলে তোমাকে আজ মাদক বিক্রি করতে হতোনা।

একদিন যেই মাদক খেয়ে তার মা তার যত্ন নিতে পারেনি আজ আবার তার ছেলে সেই মাদক বিক্রি করছে।

অনেক মা-বাবাই হয়তো আবার মাদক নিবে। তাদের ছেলেমেয়েরাও হয়তো অনাদর, অযত্নে বেড়ে উঠবে। যখন সময় থাকবেনা তখন আবার ক্ষমা চাইবে।

কিন্তু নতুন করে আর জীবন শুরু করা যাবে না।

এমনিভাবে অনেক জীবন হারিয়ে যাবে অনাদর, অবহেলায়।

You Might Also Like

No Comments

Leave a Reply

error: Content is protected !!