হার্টবিট ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। হাত দিয়ে স্পর্শ করে অনুভব করতে পারলাম কম্পন হচ্ছে। আস্তে আস্তে শব্দও শুনা যাচ্ছে। দাড়িয়ে আছি রহস্যময় আলুটিলা গুহার সামনে। আমার সাথে রয়েছেন সুজনদা এবং নাহিদ।
গুহার সামনে আসার আগেই কয়েকজনের আরেকটি দল দাড়িয়ে ছিলেন। তাদের সাথে কয়েকজন মেয়েও রয়েছেন। তারা মশাল হাতে নিয়ে দাড়িয়ে আছেন।
কিন্তু আগুন যে ধরাতে হবে আর সেজন্য যে দেয়াশলাই লাগবে সেটা আনতেই ভুলে গেছেন। এখন এতো কাছে এসেও অ্যাডভেঞ্চার হলো না। এই দুঃখে তারা মন খারাপ করে দাড়িয়ে আছেন।
এমন সময় সুজনদা এবং নাহিদ বলে উঠলেন, তাদের কাছেও দেয়াশলাই নাই। তার মানে আমাদের আর যাওয়া হচ্ছে না। আমি মনে মনে খুব খুশি হয়ে গেলাম।
ছোটবেলা থেকেই আমার অন্ধকারে খুব ভয় লাগে। একমাত্র রাতে ঘুমানো ছাড়া আমি অন্ধকারে থাকতে পারিনা।
আর বাইরে মুভিতে দেখেছি অনেক সময় গুহা দিয়ে যাওয়ার সময় ভেঙে পড়তে।
এবং মাঝে মাঝে ঘুমের ঘুরে স্বপ্ন দেখতাম একটা অন্ধকার গুহার মধ্যে আটকা পড়ে আছি। দুই দিক থেকেই মুখ বন্ধ হয়ে গেছে। বের হওয়ার জন্য অনেক চিষ্টা করছি। অনেক চিৎকার করে ডাকছি। কিন্তু আমার চিৎকার গুহার মধ্যেই প্রতিধ্বনি হয়েছে। কেউ আমাকে বাচাতে আসছে না। এমন সময় ঘুম ভেঙে যেতো।
মনে মনে যখন এইগুলো ভাবছি তখন পাশ থেকে আমাদের ড্রাইভার বললেন, চিন্তা করেন কেন? আমার কাছে দেয়াশলাই আছে। চলেন যাই।
সাথে সাথে আমার মন আবার খারাপ হয়ে গেলো।
আজ সকালেই ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম এসেছি ইউএস বাংলা এয়ারলাইন্সে। যখন ঢাকা এয়ারপোর্টে প্লেনে উঠবো তখন রোদের তেজিভাব অনুভব করেছিলাম। আস্তে আস্তে দিন বাড়ার সাথে সাথে রোদের প্রখরতা যে বাড়বে তা অনুমান করা গিয়েছিলো।
চট্টগ্রাম থেকে নন-এসি বাসে করে শান্তি পরিবহনে খাগড়াছড়ি এসেছি। এই রুটে এটাই সবচেয়ে ভালো পরিবহন। নামে শান্তি পরিবহন হলেও আমার চট্টগ্রাম টু খাগড়াছড়ি জার্নি অশান্তিময় করে ফেলেছে।
যেমন গরম ছিলো ঠিক তেমনি শান্তি পরিবহনের ড্রাইভারও ছিলো মাথা গরম অশান্ত প্রকৃতির। তার সামনে কোন বাস থাকলেই তাকে পেছনে ফেলার জন্য উঠে পড়ে লাগতো। চট্টগ্রাম থেকে খাগড়াছড়ি তার বাশির কর্কশ শব্দে অতিষ্ট হয়ে শেষ পর্যন্ত খাগড়াছড়ি শহরে এসেছি বেলা চারটার দিকে।
ইচ্ছে ছিলো আফিসে গিয়ে আজ পরিচয় পর্বটা সেড়ে ফেলে কিছু কাজ করে নিবো। কিন্তু দেড়ি হয়ে যাওয়াতে সুজনদা বললেন, একবারে কালই যেতে পারেন। তাই হোটেলে গোসল করে কাছেই আলুটিলা গুহা যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।
কোন সিএনজি বা মাহেন্দ্রই পাচশত টাকার নিচে যেতে রাজি হচ্ছে না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত একটা মাহেন্দ্র চারশত টাকায় রাজি হলো। আমরা যে হোটেলের সামনে থেকে উঠেছি আলুটিলা গুহা ঘুরিয়ে আমাদেরকে আবার সেই হোটেলের সামনেই নামিয়ে দিয়ে যাবে।
হঠাৎ ডাক শুনে চেতনা ফিরে পেলাম।
মশালে আগুন ধরিয়ে তারা গুহার ভেতরে প্রবেশ করার জন্য হাসি মুখে অপেক্ষা করছে। তাদের চেহারার মধ্যে উত্তেজনার ছাপ। একটা কিছু জয় করতে গেলে যেমনটা হয়!
আমার অবস্থা হয়তো ড্রাইভার বুঝতে পেরেছেন।
তিনি পাশে এসে বললেন, ভাইয়া, আমি এই গুহা দিয়ে অনেক আগে থেকেই বহুবার গিয়েছি। তখন এখানে আসার জন্য এখনকার মতো ভালো যোগাযোগ ছিলো না। আমরা বন্ধুরা স্কুল পালিয়ে এখানে আসতাম। গাছের লতা বেয়ে নিচে নামতাম এবং উপরে উঠতাম।
আসলে এটাই ছিলো আসল অ্যাডভেঞ্চার। পরে ড্রাইভার বললেন, দশ থেকে সর্বোচ্চ পনের মিনিট লাগবে। পাশ থেকে নাহিদ বলে উঠলো, ভাইয়া এর আগে আমিও গিয়েছি। বেশিক্ষণ লাগেনা।
যখন তারা আমাকে সাহস দিচ্ছে তখন গুহার সামনে তাকিয়ে দেখি আট-দশ বছরের একটা ছেলে হাতে মশাল নিয়ে দাড়িয়ে আছে। তাকে দেখে আর দাড়িয়ে থাকতে পারলাম না।
সাহস নিয়ে ঢুকে পড়লাম রহস্যময় আলুটিলা গুহায়!
ভিতরে ঢুকতে গিয়েই হিম শিতল বাতাস গায়ে লাগলো। ভয়ে এমনিতেই হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। তার উপর ঠান্ডা বাতাস। এদিকে নিচে দিয়ে অল্প অল্প পানি গড়িয়ে যাচ্ছে। মাঝে মধ্যে সেই পানিতে পা লেগে ভিজে যাচ্ছে। পানিও খুবই ঠান্ডা।
বর্ষার সময় নাকি হাটু পানি আবার কোথাও কোথাও কোমর পানিও থাকে। মানুষ অ্যাডভেঞ্চার করতে চাইলে কতোভাবেই করা যায়।
আমি একটু দ্রুতই হাটছি।
আমাদের সামনে যে দল ছিলো তাদের সাথে তাল মেলাতে গিয়ে আমি আগে চলে গিয়েছি।
পেছনে তাকিয়ে দেখি সুজনদা হাতে মশাল নিয়ে ক্লোজ-আপ মার্কা হাসি দিয়ে সেলফি তুলছেন।
সুজনদা কিছুদিন আগেই বিয়ে করেছেন। বিয়ের পর এটা তার প্রথম একা অফিসিয়াল ট্যুর। বৌদির পরীক্ষা থাকাতে তিনি সহজেই আসতে পেরেছেন। বাড়িতে গিয়ে এই সেলফি দেখিয়ে বীরত্ব দেখাতে পারবেন। সাথে নাহিদও যোগ দিয়েছেন।
সেলফি যে মানুষকে কতটা ডেসপারেট করে তা দেখে গেলো। তাদের এই কান্ড দেখে হাসি পেলো। মনে মনে সাহসও পেলাম। ভয় চলে গেলো। আমিও তাদের সাথে যোগ দিয়ে সবকটি দাত বের করে সেলফির জন্য পোজ দিলাম।
এবার আর তাড়াহুড়া করলাম না। আমরা আস্তে আস্তে এগুচ্ছি।
সামনের দলকে আর দেখা যাচ্ছে না। হালকা কথার আওয়াজ আসছে।
একটু এগুতেই দেখতে পেলাম হাতের বাম দিকে আরেকটা পথ চলে গেছে। কিন্তু সেটা একটু গিয়ে থেমে গেছে।
পাশ থেকে ড্রাইভার বললেন, আমরা যখন পালিয়ে এখানে আসতাম তখন তো অনেক দুষ্ট ছিলাম। একবার দেখি একটি দল এখানে ঢুকছে। আমরা এই জায়গায় সবাই আলো নিভিয়ে চুপ করে বসে আছি।
যখনই তারা এখানে এসেছে তখনই আমরা একসাথে ভয়ংকর আওয়াজ করলাম। তারা সবাই ভয়ে একে অপরের উপর পড়ে গেলো।
তারা হয়তো শুধু মজা করার জন্য এটা করেছেন।
কিন্তু যারা ভয় পেয়েছেন তারা অন্যদের সাথে গিয়ে হয়তো বলবেন, সেখানে অনেক ভয়ানক কান্ড হয়েছিলো। ভূত থাকে ইত্যাদি ইত্যাদি।
আসলে এভাবেই অনেক রহস্যের সৃষ্টি হয়। যার মধ্যে অনেক কিছুরই হয়তো এভাবে প্রকাশ পায়না। যুগের পর যুগ এভাবেই রহস্য থেকে যায়।
যাই হোক, কিছু কিছু জায়গায় মাথা নামিয়ে কুজু হয়ে যেতে হয়। দেখতে দেখতে আমরা আলোর পথ দেখতে পেলাম। আমাদের রহস্যময় আলুটিলা গুহা অভিযান শেষ হলো। গুহার শেষ জায়গায় দাড়িয়ে আমরা তিনজনে আবার একটা সেলফি তুললাম।
যেখান থেকে আমরা নেমেছি সেখানে কয়েক মিনিট হেটেই চলে এসেছি। অথচ নামার সময় অনেকক্ষণ নিচে নেমেছি। খাড়া খাড়া সিড়ি তারপর আবার পাহাড়ি মাটির রাস্তা বেয়ে নিচে নেমে আলুটিলা গুহার সামনে যেতে হয়েছে।
পরে ড্রাইভার বলেছে, দুইদিক দিয়েই গুহা অতিক্রম করা যায়। যারা উপর দিক থেকে গুহাতে প্রবেশ করে নিচের দিকে নেমে উপরে আসেন তাদের অনেক পরিশ্রম করতে হয় খাড়া খাড়া সিড়ির জন্য। আর নিচে দিয়ে গেলে উপরে উঠতে বেশি বেগ পেতে হয় না।
আমরা যখন এখানে আসি তখন প্রায় সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছিলো। তাই আমরা তখন আর দেরি না করে সরাসরি গুহা অভিযানে চলে যাই।
পিপাসা পেয়েছে।
ডাবের পানি আমার খুবই ভালো লাগে। তাই মিনারেল ওয়াটার না খেয়ে আমরা চারজনে ডাব খেলাম চল্লিশ টাকা করে। ঢাকার সমান দামই।
ডাব খাওয়ার সময় সুজনদা বললেন, দাদা আমার প্রচন্ড ভয় লাগছিলো। আমি না গেলে আপনারা যদি না যান তখনতো আপনাদের মন খারাপ হবে তাই বলিনি।
নাহিদ বললো, ভাইয়া আমারও কিছুটা ভয় করছিলো। কিন্তু আমি যেহেতু আগে গিয়েছি তাই চাচ্ছিলাম আপনি যেহেতু নতুন এসেছেন তাই আপনিও যান। আসলে নতুন কিছু কাউকে দেখাতে পারলে ভালো লাগে।
তার দিকে তাকিয়ে দেখলাম, তার চেহারায় তৃপ্তির হাসি দেখা যাচ্ছে।
আসলে সবাই মনে মনে ভয় পেলেও কেউ বলে নি। গুহার মতোই মানুষের মনও রহস্যময়।
যেখানে আমরা ডাব খাচ্ছি সেখান থেকে দাড়িয়ে খাগড়াছড়ি শহর পুরাটা দেখা যায়। চারদিকে উচু উচু পাহাড়। তার মধ্যে সমতলে খাগড়াছড়ি শহর। আমাদের ড্রাইভার বললেন, পাশেই ওয়াচ টাওয়ার আছে। সেখান থেকে ভালোভাবে খাগড়াছড়ি শহর দেখা যায়।
আমরা তার সাথে সেখানে গেলাম। সিড়ি বেয়ে উপরে উঠেছি। তখন চারদিকে অন্ধকার নেমে এসেছে।
খাগড়াছড়ি শহরের আলো মিটিমিটি করে জ্বলছে।
হালকা বাতাস বইছে।
দিনে যে প্রখর রোদ এবং সাথে গরম ছিলো তা আস্তে আস্তে কমে যাচ্ছে। বাতাস ভালো লাগছে। আরো কিছুক্ষণ থাকতে ইচ্ছে করছিলো। কিন্তু পুলিশ এসে নামিয়ে দিয়েছে সিকিউরিটি ইস্যুর জন্য।
নাহিদ আর ড্রাইভারের মধ্যে ভালো ভাব হয়ে গেছে। আমরা আগামীকাল সকালে সাজেক ভ্যালি যাবো। কিভাবে যাবো সে বিষয়ে নাহিদ তার সাথে কথা বলছে।
তাদের কথা হালকা শুনা যাচ্ছে। আমরা হোটেলের সামনে চলে এসেছি। নাহিদ বললো, ভাইয়া ড্রাইভার আমাদের নিয়ে যেতে চায়। সে পারবে। পাচ হাজার টাকা চায়।
ড্রাইভারের আজকের আচরণ ভালো লেগেছে। আমাদের সাথে সবসময় থেকেছে। খুবই হেল্পফুল। নাম সবুজ।
আমরা যেহেতু তিনজন তাই চান্দের গাড়ি নিয়ে গেলে খরচ বেশি পড়বে। আর অন্য দলের সাথে গেলে নিজেদের মত করে ঘুরা যাবে না। তাই রাজি হয়ে গেলাম।
আগামীকাল সকাল আটটায় সে আমাদের হোটেল থেকে নিয়ে যাবে। কাল সকালে সাজেক ভ্যালি যাবো! এখন থেকেই ভিতরে ভিতরে উত্তেজনা অনুভব করছি!
No Comments