Travel

জার্নি বাই এয়ারঃ ঢাকা টু কলকাতা

February 7, 2017
জার্নি বাই এয়ার

আপনার পাসপোর্টে প্রবলেম আছে। আপনি এই বছরের জানুয়ারীতে সৌদি আরবে গিয়েছিলেন। আপনাকে বসতে হবে। ইমিগ্রেশন অফিসার তার ডেস্কের পিছনে ইশারা করে চেয়ারে বসতে বললেন।

দেখিয়ে দেওয়া জায়গায় বসে আছি। এই প্রথম দেশের বাহিরে যাচ্ছি দুই দিনের জন্য।

আজ ২৫ জুলাই ২০১৬ সারাদিন অফিসের কাজে একটি মিটিং-এ থাকবো। আগামীকাল ২৬ জুলাই ২০১৬, কলকাতা শহরে ঘুড়ে রাতের ফ্লাইটে আবার দেশে ফিরে আসবো।

এর আগে অন্য কোন দেশের ভিসাও পাইনি যে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিলো। আর পাসপোর্টও নতুন। তাই সেই সম্ভাবনাও নেই। কিন্তু তাদের সার্ভারে কেন দেখাচ্ছে সৌদি আরবে গিয়েছিলাম?

ইমিগ্রেশন অফিসার আমার পাসপোর্ট নিয়ে আমার সামনে বসা তার বসের কাছে দিলেন। এবং আমার সম্পর্কে বললেন।

আমার পাসপোর্ট হাতে নিয়ে তার সামনে থাকা কম্পিউটারে চেক করলেন। ঘুরে আমার দিকে তাকালেন।

আমি শান্ত।

যেন কিছুই হয়নি এমন ভাবে বসে আছি। আমার এইভাব দেখে তিনি মনে হচ্ছে অবাক হচ্ছেন।

আপনি কি এই প্রথম যাচ্ছেন? কি করতে যাচ্ছেন? আপনি কি করেন? কতদিন থাকবেন?

এই প্রশ্নগুলো তিনি করলেন। আমি খুবই শান্তভাবে তার কথার উত্তর দিলাম।

তারপর একটু থেমে পাসপোর্ট নাড়াচাড়া করে তার অফিসারকে ডেকে নতুন করে নাম এন্ট্রি করে আমাকে ছেড়ে দিতে বললেন। ইমিগ্রেশন অফিসারের ডেস্কের উপরে থাকা ক্যামেরায় ছবি নিয়ে পাসপোর্টে সিল দিয়ে আমাকে ছেড়ে দিলেন।

ইমিগ্রেশন শেষ করে স্টীলের হেলানো চেয়ারে গিয়ে বসলাম। টের পেলাম একটু একটু ক্ষোধা লাগছে। ভোর পাচটায় ঘোম থেকে উঠে রেডি হয়ে বাসা থেকে বেরিয়েছি। এতো সকালে উঠে খেতে ইচ্ছে করছিলো না। হালকা খেয়ে বেরিয়ে পরেছিলাম।

৯:২০ মিনিট-এ ফ্লাইট। যেতে ৪০ মিনিট লাগবে। সেখানে নেমেই সরাসরি অফিসে যেতে হবে। প্লেনে কিছু খাবার দিবে। সেটাই ভরসা। সেই আশায় থাকতে হচ্ছে।

সাড়ে সাতটায় এয়ারপোর্টে চলে এসেছিলাম। বোর্ডিং এর জন্য লাইনে দাড়ালাম। যখন আমার পালা আসলো তখন ডেস্কে থাকা ভদ্রলোক আমার পাসপোর্ট আর টিকিট ফেরত দিয়ে বললেন, এখন সিংগাপোর আর থাইল্যান্ডের বোর্ডিং চলছে। কলকাতার বোর্ডিং আটটায় শুরু হবে।

হাতে এখনও একঘন্টা আছে। এয়ার এরাবিয়ার পাশে রাখা চেয়ারে গিয়ে বসলাম। এয়ার এরাবিয়ার বোর্ডিং লাইনে মধ্য বয়সী, অল্প বয়সী বিভিন্ন ধরনের যাত্রী দাড়িয়ে আছেন। তারা নিশ্চয় সৌদি আরবে কাজে যাচ্ছেন।

কেউ হয়তো তার পরিবারকে রেখে যাচ্ছেন, কেউ তার সদ্য বিবাহিত বউকে রেখে যাচ্ছেন, ছোট ছোট ছেলেমেয়েকে রেখে যাচ্ছেন, বয়স্ক মা-বাবকে রেখে যাচ্ছেন।

তারা সেখানে যাচ্ছেন বেশি টাকা ইনকাম করার জন্য।

যাদেরকে রেখে যাচ্ছেন তাদের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য, ভালো জামা-কাপড় পড়ানোর জন্য, ভালো খাওয়ানোর জন্য, ছেলেমেয়েকে স্কুলে পাঠানোর জন্য। তার দুচোখে রঙিন স্বপ্ন।

একদিন তার সংসার আনন্দে ভরে যাবে। তার ছেলেমেয়েরা পড়ালেখা করে যখন চাকরী বা ব্যবসা করবে তখন সে দেশে চলে আসবে। বাকিটা সময় সে একটু নিশ্চিন্তে কাটাতে পারবে।

কিন্তু তার এই স্বপ্ন পূরন করতে গিয়ে অনেক কিছু তার জীবন থেকে হারিয়ে যাবে।

প্রিয় বাব-মা যখন মারা যাবে তখন হয়তো সে পাশেই থাকতে পারবে না। তার প্রিয় স্ত্রী যখন অসুস্থ হয়ে পড়বে তখন হয়তো সে তার পাশে থাকতে পারবে না।

সে বিদেশে থেকে শুনে নিরবে চোখের পানি ফেলা ছাড়া কিছুই করতে পারবে না। তার নিজের চোখের পানি এভাবেই ঝড়ে আবার শুকিয়ে যাবে।

তাদের এই নিরলস চেষ্টায় এগিয়ে চলেছে আমাদের প্রিয় দেশ। আর এর বাহাবা নিচ্ছেন আমাদের শাসনকর্তারা।

প্লেনে উঠার জন্য ডাক শুনে চিন্তায় ছেদ পড়লো। সবাই উঠে দাড়ালেন। ১৬ নাম্বার গেইট দিয়ে আমাদের যেতে হবে। লম্বা লাইন হয়ে গেছে। নিরাপত্তা দরজা দিয়ে ঢুকতে হচ্ছে সবাইকে। বেল্ট, হাত ঘড়ি, মোবাইল, চাবি, ল্যাপটপ, ব্লেজার এগুলো খুলে আমাদেরকে নিরাপত্তা দরজা পেরুতে হয়েছে। হযবরল অবস্থা।

লম্বা করিডোর পেরিয়ে আমরা বিমানে ঢুকলাম।

ফ্লাইট নাম্বার বিজি ০০৯৩। সিট নাম্বার ১২ই।

সিট নাম্বার খুজে বসতে গিয়ে দেখি জানালার পাশে। পরিচিত জনেরা বলে দিয়েছিলেন, যেহেতু তুমি প্রথম প্লেনে উঠছো তাই বোর্ডিং করার সময় বলবে যাতে করে জানালার পাশে সিট দেয়।

আমার বলতে ইচ্ছে করেনি। যেখানে পাবো সেখানেই বসবো। অবশ্য মাঝে মাঝে নিয়তির উপর ছেড়ে দিয়ে একটু ভাগ্যটা পরীক্ষা করলে ভালই লাগে।

যাই হোক, জানালার পাশে গিয়ে বসলাম। এসি বাসের থেকে একটু চাপা। সিট আরামদায়ক। নীল কাভার। হাল্কা পাতার ছবি আছে। সিটের উপরে সাদা কাপড়ের একটি কাভার। তার উপর বিমানের লগো।

অনেকক্ষণ বসে আছি। ৯:২০ বেজে গেছে। কিন্তু প্লেন ছাড়ছে না।

নয়টা পয়তাল্লিশে প্লেন আবার আস্তে আস্তে চলা শুরু করেছে। মেইন রানওয়ের দিকে যাছে। একটু গিয়ে আবার থেমে গেল।

তারপর একজন ভদ্রলোক এসে কিভাবে সিট বেল্ট বাধতে হবে তা দেখিয়ে দিলেন। এমার্জেন্সীর সময় লাইফ জ্যাকেট কোথা থেকে নিতে হবে এবং কিভাবে ব্যবহার করতে হবে, কি সাইন দেখে দরজার দিকে যেতে হবে তা বলে দিলেন।

এরপর দৈনিক পত্রিকা নিয়ে আসলেন একজন। যার যার পছন্দ অনুযায়ি পত্রিকা নিয়ে নিলেন।

এয়ারপোর্টে এসে মোবাইলে নিউজ আপডেট দেখে নিয়েছি। তাই খবরের কাগজ আর নেইনি।

যেহেতু জানালার পাশে বসেছি তাই জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখে দেখে যেতে পারবো। এই সময়টা অন্য কিছু করতে চাইনা।

দশটার পাচ মিনিট আগে প্লেন চলতে শুরু করেছে।

আস্তে আস্তে গতি বাড়ছে। গতি হঠাৎ করে বেড়ে গেলো। প্লেন সামনের দিকে ছোটছে তো ছোটছেই। আর যেন পেছন ফিরে তাকানোর সুযোগ নেই। পেছনে জমে থাকা সব দুখ-বেদনা ফেলে এ যেন এক নতুন পথে দ্রুত গতিতে ছোটে চলেছি। এবং টের পেলাম প্লেন টেক অফ করলো। সামনের দিকে উচু হয়ে গেলো। শরীরটা হালকা হয়ে গেল নিমিশেই। যেন ভাসতে লাগলাম।

অসীম আকাশে মিশে যাওয়ার জন্য উপরে উঠে চলেছি। নিজের মনকে আকাশের মত বিশাল করার জন্যই যেন এই উঠে চলা। এ এক ক্ষুদ্র থেকে এক বিশাল আকাশের সাথে মিশে যাওয়ার চেষ্টা।

জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে দেখি দূরে গাছগুলো একটা আরেকটার সাথে লেগে যাচ্ছে। ব্লার হয়ে যাচ্ছে।

প্লেন উপরে উঠছে তো উঠছেই। নিচের দিকে চোখ গেল। আস্তে আস্তে দূরত্ব বাড়ছে। আকাশে উঠছি। নিচের সবকিছু ছোট হয়ে যাচ্ছে। আর্মি স্টেডিয়ামের উপর দিয়ে যাচ্ছি।

তারপরেই প্লেন ডানে টার্ন নিলো। ডান দিকে হেলে পরলাম।

নিচে থাকা বিল্ডিংগুলো ছোট হতে হতে ছবিতে থাকা ঘরের মত দেখাচ্ছে।

আমি যেখানটায় বসেছি তা ডানপাশের একদম পাখার উপরে। ডানার দিকে তাকিয়ে দেখলাম হালকা কাপছে।

এখন আমরা মেঘের ভিতর দিয়ে উপরে উঠছি। আচ্ছা বাইরে এখন তাপমাত্রা কত হতে পারে? বৃষ্টি নামলেই যেমন শরীর জুড়িয়ে যায় তাহলে মেঘের ভিতর দিয়ে যাওয়ার সময় কেমন ঠান্ডা লাগবে? এ কথা মাথায় ঘোর পাক খাচ্ছে।

জানালার সাথে মেঘ যেন লেগে যাচ্ছে। মেঘ বেধ করে উপরের দিকে প্লেন চলতে শুরু করেছে। হাত দিয়ে জানালার উপরে রাখলাম। অনুভব করতে চাইলাম। শিহরিত হচ্ছি মনে মনে ভেবে যে এই গ্লাসটার পরেইতো মেঘ।

হঠাৎ প্লেন আবার নিচে নামা শুরু করলো। আবার কেন নিচে নামা শুরু করলো?

আমরা কয়েক মিনিট উপরে উঠতে থাকলেও শুধু মেঘই দেখতে পাচ্ছিলাম। তাই কি প্লেন নিচে নেমে যাচ্ছে?

হঠাৎ করে প্লেন নিচে পরে গেল।

সবাই ভয়ে চিৎকার করে উঠলেন।

আমি হাত দিয়ে সামনের সিটের উপরে ধরে ফেললাম।

অ্যানাউন্স হচ্ছে সিট বেল্ট বেধে ফেলার জন্য। না উঠতে উঠতেই কি কলকাতা চলে এসেছি? সাথে সাথে সিট বেল্ট বেধে ফেললাম। ভয় পেয়ে শক্ত হয়ে বসে আছি।

মনে পড়ছে অ্যামেলিয়া মুভির কথা।

অ্যামেলিয়া প্রথম নারী যিনি একা আটলান্টিক পারি দিয়েছিলেন।

একদিন এমনি প্লেন চালাতে গিয়ে বৈরি আবহাওয়ার কবলে পড়েন এবং দূর্ঘটনায় পরে তিনি মারা যান। একথা মনে মনে ভেবে ভয় লাগছিলো।

একটু পরেই প্লেন আবার উপড়ে উঠা শুরু করেছে। এবং আমরা মেঘের উপরে চলে গেলাম। আমরা রোদ দেখতে পাচ্ছি।

নিচে তাকিয়ে দেখতে পাচ্ছি আমরা যেন সাদা-কালো, হালকা-ঘন রঙের পাহাড়ের উপর ভেসে আছি। মনে হচ্ছে পাহাড়গুলো আস্তে আস্তে সরে যাচ্ছে। নিচে এতক্ষণ ধরে যে বাড়ি-ঘর দেখতে পাচ্ছিলাম তা আর দেখা যাচ্ছে না।

সিট বেল্ট খোলে ফেলার ঘোষণা শুনে খুলে ফেললাম।

খাবারের বক্স এবং একটা হাফ লিটারের পানির বোতল দিয়ে গেলেন। সামনের সিটের পেছন দিক দিয়ে ট্রে আটকানো ছিলো। তা খুলে খাবারের পেকেট খুলে দেখি একটি মিনি স্যান্ডউইচ, এক স্লাইস কেক এবং এক পেকেট বাদাম। ক্ষুধা থাকাতে তাড়াতাড়ি খেয়ে নিলাম।

খাওয়া শেষ করতে না করতেই খালি পেকেট এবং পানির খালি বোতলগুলি এসে নিয়ে গেলেন।

এবং এর সাথে সাথেই সিট বেল্ট বেধে ফেলার ঘোষণা এলো।

এবার আমরা চলে এসেছি। আস্তে আস্তে আবার প্লেন নিচের দিকে নামা শুরু করেছে। মেঘ বেধ করে নিচের দিকে নামছি। এবার আরো বেশি ঘন-কালো মেঘ। জানালার গ্লাসের গায়ে মেঘের পানি লেগে যাচ্ছে। প্লেনের পাখা মেঘের পানিতে বিজে যাচ্ছে।

আমরা মেঘের নিচে নেমে গেলাম। ডানার দিকে তাকিয়ে দেখছি বৃষ্টি পড়ছে। জানালায়ও বৃষ্টির ফোটা পড়ছে।

নিচে নামতে নামতে টের পেলাম প্লেন ল্যান্ড করেছে। একটু ধাক্কা খেয়ে উপড়ের দিকে উঠে গেলাম। বাস হঠাৎ ব্রেক করলে যেমন লাগে তেমন।

নামার সময় ডানার দিকে তাকিয়ে দেখলাম ডানার পেছনের দিকটা একটু খুলে গেছে। আমার কাছে মনে হল প্লেন এর গতি কমানোর জন্যই হয়তো এমনটা করা হয়েছে।

প্লেন সামনের দিকে ছোটে চলেছে। গতি কমে যাচ্ছে। কমতে কমতে একদম থেমে গেল।

বাইরে প্রচন্ড বৃষ্টি হচ্ছে।

সবাই নামার জন্য অস্থির হয়ে গেছেন। মনে হল লম্বা একটা জার্নি করে টায়ার্ড। আর বসে থাকতে ইচ্ছে করছেনা। এখনই নেমে যার যার উদ্দেশ্যে রওনা দিতে হবে।

সিট ছেড়ে সবাই দাড়িয়ে আছেন। দরজা এখনও খোলেনি। সবাই কথা বলছেন। আস্তে আস্তে কথা বললেও সবাই একসাথে কথা বলাতে বেশ শব্দ হচ্ছে।

একজনকে ঠাট্টা করে বলতে শুনলাম, এদের এয়ারপোর্টে পানি জমে আছে হাটু পরিমান। আর আমাদের ঢাকাতে রাস্তায় পানি জমলেই আমরা অনেক কথা বলা শুরু করি। আমাদের মেয়র যদি এখন থাকতেন তাহলে নিশ্চয়ই খুশি হতেন।

প্লেন থেকে বেরিয়ে ইমিগ্রেশন লাইনে দাড়ালাম।

অনেকগুলো কাউন্টার। খুব দ্রুত সামনের দিকে এগুচ্ছি। তার মানে দ্রুত কাজ করছেন ইমিগ্রেশন অফিসাররা।

খুবই খোলামেলা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। দেখে খুব ভালো লাগলো। কয়েক মিনিটেই ইমিগ্রেশন শেষ হয়ে গেল।

লাগেজ নিয়ে এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে দেখি প্রচন্ড বৃষ্টি হচ্ছে।

টেক্সি নিয়ে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে ছুটছি।

You Might Also Like

No Comments

Leave a Reply

error: Content is protected !!