Movie Review

আয়নাবাজিঃ জীবন গল্পে নানা ধাধা

December 2, 2016
আয়নাবাজি

দর্শক হলে গিয়ে মুভি দেখে তা আয়নাবাজি মুভি রিলিজ হওয়ার পর প্রমাণিত হলো।

প্রায়ই মুভির ডিরেক্টর বা শিল্পীরা হলে গিয়ে মুভি দেখার জন্য দর্শকদের অনুরোধ করে থাকেন।

কোন মুভি যদি দর্শকদের ভালো লাগে তাহলে তারা স্বতস্ফুর্তভাবেই হলে গিয়ে মুভি দেখবে। তখন হল কর্তৃপক্ষই দর্শক সামলাতে পারবে না।

হল ভেঙে শপিং মলও করতে হবে না। হলকে ঘিরেই গড়ে উঠবে শপিংমল বা প্রতি শপিংমলে সিনেপ্লেক্স রাখতে আগ্রহী হবে শপিং মল কর্তৃপক্ষ।

আয়নাবাজি জ্বরে ভুগছেন দর্শকরা এই খবর প্রতিনিয়তই আসছে মিডিয়াতে বা সামাজিক যোগাযোগ সাইটে।

সবাই মুগ্ধ।

আয়নাবাজি কি অসাধারণ মুভি যে জন্য দর্শকরা হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন?

যারা অভিনয় করেছেন তারাও কি এখানে অসাধারণ অভিনয় করেছেন যা এর আগে তারা আর কখনো করেন নি?

এই প্রশ্নগুলোর উত্তর ভিন্ন হতে পারে দর্শক ভেদে।

কিন্তু এটা বলা যায়, মুভিটা একটু আলাদা। আলাদা হলো ক্যামেরার কাজ এর জন্য।

উপর থেকে ঢাকা শহরের দৃশ্য, সকালের ঢাকা, যানঝটের ঢাকা, বৃষ্টির ঢাকা সবই যেন আলাদা।

আবার সকালে বাজারের দৃশ্য বিশেষত সবজির উপর পানি ছিটানো, মাছের বাজার,ভুরিগঙ্গা নদীতে ছোট ছোট ডিঙ্গী নৌকার নদী পারাপারের দৃশ্য, নদীতে ভেসে থাকা এলোমেলো লঞ্চ এবং বিকেল বেলা নদীর পানির উপর লাল সূর্য পড়ে হাজারো সোনালি আলো ছড়ানো সবই যেন আলাদা।

আর এতো সব আলাদা ক্যামেরার কাজই দর্শকদের চোখ পর্দায় টেনে রাখতে সফল হয়েছে।

চিত্রগ্রাহক রাশেদ জামান প্রসংশা পাওয়ার মতো কাজ করেছেন মুভিটিতে প্রতিদিনের এই দৃশ্যগুলো নতুন করে দেখানোর জন্য।

মুভিটিতে আয়না চরিত্রে চঞ্চল প্রায় আদা ডজন চরিত্রে অভিনয় করেছেন। সবাই তার অভিনয়ে মুগ্ধ। কিন্তু বরাবরই চঞ্চল ভালো অভিনয় করে থাকেন।

মুভিটিতে আয়নার চরিত্রটাও প্রচলিত বাংলা মুভি থেকে একটু আলাদা।

আয়নার মা খুবই অসুস্থ। চিকিৎসার জন্য টাকার দরকার। কিন্তু সে কোথাও টাকা পায়না। শেষ পর্যন্ত সে টাকা পায় কিন্তু বিনিময়ে তাকে তিন মাসের জন্য জেলে যেতে হবে যিনি টাকা দিবেন তার হয়ে।

সে নিরুপায় হয়ে জেলে যায়। যার হয়ে সে জেলে যাবে তার চেহারা, হাটা চলা, কথা বলার স্টাইল মিল থাকতে হবে নতুবা সে যে অন্যের হয়ে জেলে এসেছে তা ধরা পড়ে যাবে। তাই তাকে জেলের মধ্যে অন্যের হয়ে অভিনয় করতে হয়।

সে ঢুকে পড়ে আরেক জনের মধ্যে। আয়না হয়ে উঠে আরেক জন মানুষ। সমাজের খারাপ মানুষ। সমাজের ভয়ানক চরিত্র।

তিন মাসের কথা বলা হলেও তার জেল থেকে বেরিয়ে আসতে সময় লাগে তিন বছর। এসে দেখে তার মা আর বেচে নেই।

সাধারনত এখানে যেটা হতে পারতো আয়না জেল থেকে বেরিয়ে প্রতিশোধ নিতে পারতো।

তা সে করে না।

কিন্তু উল্টো সে আরেকজনের হয়ে জেল খেটেই যায় যারা অনেক বড় অপরাধী।

কোরিয়ান যে মুভি থেকে আয়নাবাজি মুভি নকল করার অভিযোগ উঠেছে তাতে কিন্তু প্রতিশোধ নেয়ার বিষয়টিই দেখানো হয়েছে।

আয়নাবাজি মুভিতে গল্পটা ঘুরিয়ে দেয়া হয়েছে।

এখানে দর্শক বলতে পারেন, বুঝো নাই বেপারটা? আমরা ধরে ফেলেছি।

যাই হোক, প্রতিশোধ না নিয়ে সে যে মাসের পর মাস ভয়ংকর মানুষের হয়ে জেল খেটে যাচ্ছে তার বিনিময়ে সে কত টাকা পাচ্ছে তা দেখা যায়নি।

সে একটি অভিনয় স্কুল চালায়। সেখানে ছোট ছোট ছেলেমেয়ে অভিনয় শিখে। তারা কি তাকে টাকা দিয়ে অভিনয় শিখে নাকি তাদের বিনা মূল্যে অভিনয় শিখায় তা জানা যায়নি।

যদি আয়না টাকা না নিয়ে অভিনয় শিখায় তাহলে অভিনয় স্কুল চালানোর টাকা কোথা থেকে আসে? তার অন্যকোন আয়ের উৎস কি তা মুভিতে দেখে যায়নি।

সে কি শুধু আরেকজনের চরিত্রের মধ্যে ঢুকে গিয়ে আনন্দ পাওয়ার জন্যই অন্যের হয়ে জেল খাটতে রাজি হয়?

কিন্তু সে যাদের হয়ে জেল খাটে তাদের মধ্যে একজন একটা মেয়েকে উত্যাক্ত করত। আয়না যখন জেলে তখন প্রকৃত অপরাধী জেলের বাইরে থেকে প্রতি রাতে মেয়েটিকে ভয় দেখায়।

মেয়েটি ভয়ে বাসা থেকে বের হতে পারেনা। তার পরিবার তাকে বাসা থেকে বের হতে দেয়না। কারো সাথে কথা বলতে দেয়না। পরিবারটি খুবই অসহায় অবস্থার মধ্যে পড়ে যায়।

এমন একটা খারাপ মানুষের হয়ে সে জেল খাটে যাদের কারনে সমাজে শান্তি বিঘিন্ত হয়। অথচ আয়নার মধ্যে কোন অনুশুচনা নেই। একের পর এক সে এই ধরনের অপরাধীদের হয়ে জেল খাটে। কিন্তু তার মধ্যে কোন অপরাধবোধ নেই।

জেলে গিয়ে যখন সে ‘পাপ জমাই’ গানের সাথে নাচতে থাকে তখন শেষ মুহূর্তে তাকে একটু অন্যমনস্ক দেখা যায়। একটু চিন্তিত দেখা যায়। কিন্তু সে কি তার অন্যায় কাজ বুঝতে পারে?

মুভির শেষদিকে এক রাজনৈতিক নেতার হয়ে তাকে জেলে যেতে বলা হয়। কিন্তু সে এবার জেলে যেতে অস্বীকার করে।

এর কারন হলো, তার পাড়ায় একটি মেয়ে এসেছে। নাম হৃদি। তাকে তার ভালো লাগে। এজন্য সে জেলে যেতে চায় না।

কিন্তু সে যে অন্যায় করে যাচ্ছে, তার জন্য যে প্রকৃত অপরাধীরা জেলের বাইরে থেকে প্রতিনিয়ত অপরাধ করে যাচ্ছে তা থামানোর জন্য নয়। তখন তার কাছে সমাজের এমনকি দেশের আইনের থেকে তার ব্যাক্তি স্বার্থ মুখ্য হয়ে উঠে।

যেদিন হৃদি আয়নার পাড়াতে আসে সেদিন কাকতালিয়ভাবে তাদের দেখা হয়ে যায়। ভুলক্রমে হৃদি আয়নাকে ট্রাক ড্রাইভার ভেবে ট্রাকের ভাড়া দিয়ে চলে যায়। তখন আয়নার চাহনির মধ্যে ভালোলাগা বুঝা গেলেও হৃদির চোখে তা দেখা যায়নি।

কিন্তু একদিন হৃদি দেখতে পায় তাদের বাসার পাশেই একটি অভিনয় স্কুলে ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা অভিনয় শিখছে। সেখানে সে আয়নাকে দেখতে পায় কিন্তু তার আগে যে আয়নার সাথে তার দেখা হয়েছিলো তা সে মনে করতে পারেনি।

যাই হোক, হৃদির মধ্যে আয়না সম্পর্কে ভালো লাগা কাজ করতে থাকে। তাদের দেখা হয়। কিছু আলাপ হয়।

এই অল্প জানাশোনার মধ্যেই হৃদি আয়নার সাথে রিকশায় ঘুরে ঘুরে আয়নার বাসা ঠিক করে দেয়। আয়নার বাসায় একা একা চলে যায়।

আয়নাকে সে কিস করে।

মুভিটিতে হৃদি যখন আয়নাকে কিস করে তখন তা হৃদির হাতের আড়ালে থেকে যায়। তাদের কিস দেখা যায় নি।

কিন্তু এটা নিয়ে ইউটিউবসহ বিভিন্ন মাধ্যমে অনেক হইচই হয়েছে। তারা নিজেরাও এটা নিয়ে কথা বলেছেন।

এটার দরকার ছিলো না। তবে কোন পণ্যের প্রচারনার জন্য এমনটা করে থাকলে তাতে কিছু বলার নেই।

এর পরে তারা সিদ্ধান্ত নেয় সিলেট বেড়াতে যাবে। বাসার কাজের লোককে নিয়ে হৃদি বেরিয়ে পরে আয়নার সাথে সিলেটে যাওয়ার জন্য।

রেল স্টেশনে গিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে কিন্তু আয়না আসে না। তাদের ট্রেন চলে যায়।

হতাশ হয়ে সে তার বাড়িতে না গিয়ে সরাসরি আয়নার বাড়িতে গিয়ে দেখে তালা দেওয়া। কিন্তু অনেক অপেক্ষার পরও আয়না আসে না।

এক পর্যায়ে সে তার নিজের বাড়িতে ফিরে আসে। এবং এক ক্রাইম রিপোর্টার এর কাছ থেকে সে সব জানতে পারে।

কয়েক দিনের আলাপে শুধু ভালো লাগা দিয়ে এতটুকু কাছাকাছি যাওয়া একটা মেয়ের জীবনে কতো বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে তা আমরা বিভিন্ন সময়ে শুনে থাকি।

ভালোভাবে না জেনেই একটা ছেলের বাসায় চলে যাওয়া তারপর ফিজিক্যাল রিলেশন-এ জড়িয়ে পড়া এবং এর পরিনতি কি ভয়াবহ হতে পারে তা আগে অনেকেই চিন্তা করেন না।

প্রায়ই গোপন দৃশ্য ধারন করে তা ইন্টারনেটে ছেড়ে দিয়ে বা ছেড়ে দেয়ার ভয় দেখিয়ে ব্ল্যাকমেইল করে থাকে। তখন এতে করে সমাজে পরিবারটিকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়।

যাই হোক, আমাদের দেশের গল্প বা সিনেমায় আমরা সাধারনত হ্যাপি অ্যান্ডিং দেখতে পছন্দ করি। আর তাই বুঝি সব কিছুর বাইরে গিয়ে ন্যায়-অন্যায় বিবেচনা পাশে রেখে হ্যাপি অ্যান্ডিং হয়েছে আয়নাবাজি মুভিতে।

ফন্দি এটে জেল থেকে বেড়িয়ে সাইকেল চালাতে চালাতে তার যে উচ্ছ্বাস তা দেখে অবাক লাগে।

নিজেকে সে ফাসির হাত থেকে রক্ষা করতে পেরেছে তাই তার বাধ ভাঙা উচ্ছ্বাস থাকারই কথা। কিন্তু অপরাধীকে বাচিয়ে, আইনের চোখকে ফাকি দিয়ে, সমাজের ক্ষতি করে তার মধ্যে যেই উচ্ছ্বাস দেখা গেছে তা ভয়ানক।

শেষ দৃশ্যে হৃদির পাশে অভিনয় স্কুলে গিয়ে যখন আয়না হাসি মুখে দাড়ায় তখন হৃদিকেও হাসি মুখে তার দিকে তাকাতে দেখা যায়।

কিন্তু এখানে যদি গল্পটা ঘুরিয়ে দিতো তাহলে কেমন হতো?

যেমন, আয়না যার হয়ে জেলে গেছে তার অপরাধের জন্য তাকে ফাসিতে ঝুলতে হয়েছে।

যদিও সে ফাসির মত অন্যায় করেনি কিন্তু অন্যের হয়ে এই জগণ্য কাজ করতে গিয়ে নিজে ফেসে গেলেন।

তখন তার প্রভাব কি হতো? মানুষকে কি আরো বেশি টাচ করতো না?

জীবনের বাকে বাকে অসংখ্য ছোট বড় গল্প তৈরি হয়।

এই গল্পে রেয়েছে সন্দেহ, ভয়, সংকোচ, লজ্জা, অপরাধ এবং আরো হাজারো অজানা অনেক সত্য-মিথ্যা। তাই এই গল্পে জড়িয়ে থাকে নানা ধাধা। সত্য-মিথ্যার ধাধা।

কিছু সময় যেটা সত্য বলে মনে হয় তা সময়ের পরিক্রমায় মিথ্যা হতে পারে। আবার মিথ্যা হয়ে যেতে পারে সত্য।

কেউ কেউ জীবনের বাকে তাল মিলিয়ে জীবনকে আরো ধাধাময় করতে নতুন নতুন গল্প তৈরি করেন।

বাকে চলতে চলতে কোথায় গিয়ে থামতে হবে সে সম্পর্কে যদি ধারনা না থাকে তাহলে একসময় নিজেকেই সেই ধাধায় জরিয়ে যেতে হয়। যেটা হয়েছে আয়নার ক্ষেত্রে।

যদিও শেষ মুহূর্তে আয়না বেরিয়ে আসতে পেরেছে পুলিশকে ফাকি দিয়ে কিন্তু এটা শুধু মুভিতেই সম্ভব।

এজন্যই হয়তো ডিরেক্টর অমিতাভ রেজা মুভির শুরুতে ডিসক্লেইমার দিয়েছেন, মুভির চরিত্র কাল্পনিক।

You Might Also Like

No Comments

Leave a Reply

error: Content is protected !!